01 October 2020

নার্সিসিজম (NARCISSISM) একটি ভয়াবহ মানসিক রোগ

নার্সিসিজম (NARCISSISM) নার্সিসিস্ট (NARCISSIST)

‘নার্সারী’ নামটি শুনলে গাছ-পালা-ফুলের বাগান বা ছোট বাচ্চাদের স্কুলের কথা মনে হলেও এর পেছনের কাহিনী একটু ভিন্ন। গ্রীক পুরাণে একজন শিকারী ‘নার্সিসাস’ নিজের রূপে এতই মগ্ন ছিল যে (ঐ সময় আয়না ছিলনা তাই) সব সময় পানির কাছে গিয়ে বিভোর হয়ে নিজের প্রতিফলন দেখত। দেবতা নেমেসিস'এর অভিশাপ তাকে পানির ধারের ছোট গাছে পরিণত করে দেয় (যাতে সে সারা জীবন পানিতে নিজের প্রতিফলন দেখতে পারে)। 


আমাদের খুব প্রিয় রজনীগন্ধা হলো সেই ফুল গাছের আরেক রূপ যার নাম নার্সিসাস। দেবতা নার্সিসাস এর রূপান্তর আমাদের খুব প্রিয় একটি ফুল গাছ বা ফুলে হলেও এর অপর পিঠের রূপ খবই ভয়ংকর একটি রোগ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম নার্সিসিজম (NARCISSISM)। যার কোন ঔষুধ/প্রতিকার/নিরাময় আজও আবিষ্কার হয়নি।



অসুখের নামটি যতই খটমট শোনাক না কেন, একটু খেয়াল করলেই আমাদের আশেপাশের খুব কাছের মানুষদের মধ্যে এই রোগের প্রায় সব লক্ষন সহজে চিহ্নিত করা যায়। নার্সিসিস্ট (NARCISSIST)'রা 

(নার্সিসিজম রোগে আক্রান্তদের নার্সিসিস্ট বলে) সব সময় চায় তাদেরকে কেন্দ্র করে সব কিছু আবর্তিত হোক। তারা সব সময় চায় ছলে-বলে-কৌশলে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করতে। অন্যকে কোন ভাবেই তারা ভাল কাজের ক্রেডিট দিতে চায় না। 


কিন্তু তাদের এই আত্মকেন্দ্রিকতা ঠিক 'ঘরকুনো/INTROVERT' স্বভাবের না বলে এবং এরা 'বাইরে ঘুরে বেরানো/EXTROVERT' স্বভাবের বলে এদের চিহ্নিত করতে-করতে এরা ঠিক আপনার ক্ষতি করে ফেলে। এই সব নার্সিসিজম রোগীদের কথা-বার্তা-কাজ-কর্ম এমন চমকপ্রদক/ক্যারিশমাটিক (CHARISHMATIC) অথবা সহানুভুতিশীল/SYMPATHETIC যে আপনি কবে-কখন-কিভাবে এদের শিকার/VICTIM - হয়ে তাদের হাতের খেলার পুতুল/PUPPET-এ পরিণত হয়ে গেছেন টেরই পাবেন না। 


তাই নিজের ক্ষতি হবার আগেই আসুন জেনে নেই খুব সহজেই কিভাবে এই ভয়াবহ মানসিক রোগের রোগী নার্সিসিস্টদের চিহ্নিত করা যায়।



১) নার্সিসিস্টদের নিজের যা'ই থাক না কেন তা খুব বড়াই করে সবার কাছে সরাসরি এবং আকারে ইঙ্গিতে সব সময় প্রচার করে বেড়ায়। প্রয়োজনের খাতিরে বা প্রসঙ্গ/সময় বুঝে আমরা সবাই নিজেদের কথা অন্যকে বললেও, তারা সব সময় নিজের ছোট-বড় সব কিছু অন্যের কাছে খুব বড়াই করে বলে বেড়ায়। অন্য কথায় বলা যায় 'নিজের ঢোল নিজে পেটানো'। 


একজন নার্সিসিস্ট যদি ৩০ বছর আগে আপনাকে এক কাপ র' চা খাওয়ায় তা আজও নিজের ক্রেডিট নিতে এবং একই সাথে আপনাকে ছোট করতে আপনার চেনা-অচেনা সবাইকে বলে বেড়াবে।


 উদাহরনঃ 

- আরে 'অমুক'কে চেন না? 

    - ঐ যে ১৯৯০ সালে আমার কাছে এক কাপ র'চা খেয়ে গেল। 
      - এত কষ্ট করে র'চা বানালাম অথচ বলে কিনা দুধ চা পছন্দ করে। 
        - শুনেছি সে আজ অনেক বড় মানুষ কিন্তু সে দিন আমার র'চা না খেলে কি এত বড় মানুষ হতে পারত? 
          - ক'ই কেমন বড় মানুষ সে, একদিনও আমার কোন খবর নেয় না। 


          নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত একজন রোগী বন্ধু সেজে অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় যাতে করে পরবর্তী সময় সেটা ফলাও করে নিজের প্রচারে এবং সেই সাহায্যগ্রহনকারীকে ছোট করতে ব্যবহার করা যায়।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্টের উপকারের জন্য আপনি সাধ্যমত যা'ই করেন না কেন সে আপনার যে কোন কাজকে ভাল না বলে খারাপ বলে প্রচার করবে।


          ২) নার্সিসিস্টরা প্রথমেই দেখে নেবে আপনার দুর্বলতা বা প্রিয়-অপ্রিয় জিনিস কি কি। তারপর সেই সূত্র ধরে বন্ধু-সাহায্যকারী-চাটুকার-সমব্যথী ইত্যাদির বেশে আপনার পাশে আসবে আপনাকে প্রভাবিত/MANUPULATION করে আপনার ক্ষতি করতে। 


          ধরুন, আপনি খুব লাল গোলাপ ফুল পছন্দ করেন এবং সেই কারনে আপনার বাগানের লাল গোলাপের সুনাম আপনার এলাকার সবখানে। নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত রোগী যখন আপনাকে টার্গেট করবে শিকার হিসেবে, তখন সে একদিন আপনার লাল গোলাপের বাগান দেখতে গিয়ে এত সুন্দর-সুন্দর ভাল কথা এবং প্রশংসা করবে যে আপনি বিমোহিত হয়ে যাবেন তার কথায় (বা পাম'এ)। আপনি ধরেই নেবেন আপনি এতদিন পরে একজন সমঝদার লোকের দেখা পেয়েছেন এবং সত্যিই সে আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনি হয়তো খুশিতে তাকে আপ্যায়নও করে বসবেন। কিন্তু ঐ রোগী আপনার বাগান দেখে ফেরার পথে বিদায় বেলায় (শুরুতেই নয় কিন্তু) আপনাকে আরো অনেক ভাল-ভাল কথা বলার সঙ্গে আরো বলবে যে, লাল গোলাপের সাথে হলুদ গাঁদা ফুল'ও ভালো লাগে দেখতে। 


          আপাত দৃষ্টিতে এই কথাটির কোন দাম না থাকলেও কিছুদিন এই নার্সিসিস্টের আপনার বাগানে আসা-যাওয়ার পর দেখবেন আপনি তার কথায় প্রভাবিত হয়ে ঐ লাল গোলাপের বাগানে (যার জন্য আপনার এত সুখ্যাতি এলাকা জুড়ে) হলুদ রঙের গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো শুরু করেছেন। এবং আপনার সেই (অসুস্থ) শুভাকাঙ্খী বাগান পরিদর্শক এলাকায় প্রচার শুরু করে দিয়েছে যেঃ 


          - কই তার বাগানে নাকি শুধুই লাল গোলাপের গাছ? 

          - এটি সম্পূর্ন মিথ্যা কথা। 

          - হলুদ গাঁদা ফুলের গাছও প্রচুর আছে। 

          - আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। 

          - বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখে আস। 


          নার্সিসিস্টদের কথা এবং কাজের ধরনই এমন। আপনি সময় মতো তার কাজের প্যাটার্ন ধরতে না পারলেই বিপদ। তাদের কথা এবং কাজে বিভ্রান্ত হয়ে আপনার আমও যাবে ছালাও যাবে। যেমন আপনার লাল গোলাপের বাগানও গেল, ঐ এলাকায় আপনার সম্মানটাও গেল।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনার যে কোন কাজে সামান্য হলেও খুঁত বের করে নিজের স্বার্থে সুবিধা অনুযায়ী সবাইকে রটিয়ে বেড়াবে।



          ৩) একজন নার্সিসিস্ট'এর সাথে আপনি যতই পজিটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাল ব্যবহার বা ভাল সম্পর্ক (HEALTHY RELATION) করার চেষ্টা করেন না কেন, সে কখনই আপনার কাজ এবং অনুভূতির কোন দাম দেবে না। সে সবসময় চেষ্টা করবে আপনার সম্পর্কে যে কোন কথা খারাপ ভাবে তিল কে তাল করে রটিয়ে বা সরাসরি আপনাকে দোষ দিয়ে আপনার মনকে ছোট করে বা আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে তাকে আপনার উপরে বড়/(SUPERIOR) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে সে আপনাকে নিয়ন্ত্রন/CONTROL করতে পারে। 


          আপনি যদি নার্সিসিস্টের কাজে বা কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখান তখন সে যে কোন তুচ্ছ বিষয়ের অজুহাতে আপনার সাথে তাচ্ছিল্য - ব্যাঙ্গ - উস্কানি মূলক কথা শুরু করবে যাতে তার সাথে আপনি ঝগড়া শুরু করেন। ব্যাস, তাকে আর পায় কে? সে সবাইকে বলে বেড়াবে যে আপনি খারাপ/তার সাথে ঝগড়া করেন। অথচ তার উস্কানিতেই ঝগড়া শুরু হয়েছে ব্যাপারটি সে বেমালুম চেপে যাবে। অথবা অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ তুলে সে এত দ্রুত কথা/ঝগড়া করা শুরু করবে যে আপনি মূল প্রসঙ্গ টেনে আসল পরিস্থিতি বলার বা আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগই পাবেন না। 


          একজন নার্সিসিস্ট হলো সেই ব্যক্তি, যে সচরাচর নিজের নাক কেটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে।


          আপনি একজন নার্সিসিস্ট'কে গরমের দিনে নিজের এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে ডেকে এনে আপনার সবচেয়ে সুন্দর ডিজাইন করা দামী গ্লাসে বাগানে নিজের হাতে লাগানো এবং বড় করা গাছের কাগজি লেবু কেটে মিষ্টি ঠান্ডা শরবত বানিয়ে খেতে দিয়ে পাশের ঘরে গেলেন আরো আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। ঐ নার্সিসিস্ট আপনার বানানো শরবত এক নিমিষে সাবাড় করে ঐ গ্লাসের ভিতর ঘরের কোনা থেকে কোন ময়লা বা টিকটিকির বিষ্ঠা দিয়ে রাখবে এবং আপনি এলেই দেখিয়ে বলবে যে, সে শরবত খেয়েছে কিন্তু গ্লাসের তলায় এই ময়লা ছিল। সে চাইবে, যাতে আপনি তাকে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর জন্য হীনমন্যতা এবং আত্মগ্লানিতে ডুবে যান এবং তাকে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর বিষয়টি ভুলিয়ে আপনি অন্য বিষয়ে আরো খুশি করার চেষ্টা করেন। এবং এই নার্সিসিস্ট, কারনে -অকারনে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর প্রসঙ্গটি তুলে/খোঁটা দিয়ে আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে চেষ্টা করবে আপনাকে নিয়ন্ত্রন করে নিজের ফায়দা লোটার। 


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট সবসময় আপনার অতীতের এমন কিছু বিষয় সবাইকে বলে বেড়াবে যাতে আপনি ছোট হয়ে আত্মগ্লানীতে ভোগেন।



          ৪) আত্ম অহমিকা, অহং বোধ বা অহংকারের কিছু বিষয় আমাদের সবার মধ্যে কিছুটা থাকলেও নার্সিসিস্টদের মধ্যে আত্ম অহংকারের দাম্ভিকতা/ARROGANCE খুব প্রকটভাবে দেখা যায়। তারা নিজেদের সামনে অন্য কাউকে মানুষ হিসেবে দাম দেয় না। নিজেকে ছাড়া অন্য সবার ভিতরেই ভুল-ভ্রান্তি-দোষ-ত্রূটি দেখিয়ে সবাইকে তা ফলাও করে প্রচার করে থাকে যাতে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো যায়। 


          যেকোন কাজে একজন নার্সিসিস্টের কোন অবদান/গুরুত্ব থাক বা না থাক বা যতটুকুই থাক, সে ছলে-বলে-কৌশলে সবসময় চেষ্টা করে সেই কাজে সম্পৃক্ত অন্য সবাইকে হেয়/ছোট/DOMINATE করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ন/বড় হিসেবে প্রতিষ্টা করতে। 


          যেমনঃ দোকানে বাঁকী কিনে টাকা পরিশোধ না করা এবং টাকা পরিশোধের নামে ঘোরানো, নিকটাত্মীয়দের অর্থ-সম্পদ লোপাট, মিথ্যা কথা বলে আমানতের খেয়ানত, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি। 

          যাতে করে নার্সিসিস্টের পেছনে তার শিকার/VICTIM নিয়মিত তাগাদা বা নিজের জিনিসের মূল্য পরিশোধের জন্য বা নিজের আমানত ফিরিয়ে নিতে বা কাজের জন্য বারবার ঘোরে। তার কাজে অন্য মানুষ যতই কষ্ট পাক না কেন, একজন নার্সিসিস্ট নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ন মনে করতে বা আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে লোক দেখাতে, পারেনা এমন কোন কাজ নেই। 


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট সবসময় নিজেকে সবজান্তা মনে করে এবং বিশ্বাস করে তার নিজের কোন কাজেই সামান্যতম কোন ভুল নাই।



          ৫) একজন নার্সিসিস্টের কোন সত্যিকারের বন্ধু-বান্ধব নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন ব্যক্তি তাকে আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তার পিছে ঘোরে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির সাথে নার্সিসিস্টের সম্পর্ক থাকে। অথবা অন্য কথায় বলা যায়, একজন নার্সিসিস্ট ততক্ষণ পর্যন্তই অন্য কারো সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রন/প্রভাবিত/হেয়/ছোট (CONTROL/MANUPULATE/DOMINATE) করে নিজের অহমিকাকে ফুলিয়ে বড় (EGO BOOST) 

          করতে পারে । 


          একজন নার্সিসিস্ট, সমাজে নিজের সমমান বা তার থেকে উচ্চমানের মানুষদের বাদ দিয়ে নীচুমানের মানুষদের সাথে মেলামেশা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কারন নিজের থেকে নিচুমানের মানুষদের সহজেই প্রভাবিত করে নিজেকে বড়/SUPERIOR হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, দাম পাওয়া যায় এবং আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। ক্ষেত্র বিশেষে সুবিধা অনুযায়ী একজন নার্সিসিজম রোগীকে 'শক্তের ভক্ত-নরমের যম' হিসেবেও অন্যের সামনে আবির্ভুত হতে দেখা যায়।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট খুবই কুটিল-জটিল মনের অধিকারী (MEAN - COMPLEX MINDED), সে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হতে চায় (COLTROL FREAK) এবং তার কাছে আপনার চাওয়া-পাওয়া-আবেগ-অনুভূতির কোন দাম নাই।



          ৬) অন্যকে ব্যবহার করে অন্যের কাছ থেকে কাজ করে নেওয়াতে একজন নার্সিসিস্টের কোন জুড়ি নেই। খেয়াল করলেই দেখবেন যে, সুন্দর-সুন্দর কথা বলে বা কাকুতি-মিনিতি-হাহাকার-আফসোস (নিজেকে VICTIM হিসেবে উপস্থাপন)'এর মাধ্যমে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিখুত মুখভঙ্গী/কান্না/হাসি/অভিনয়'এর মাধ্যমে অন্যকে প্রভাবিত করে একজন নার্সিসিস্ট সহজেই শুধু মাত্র নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অন্যকে দিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে নেয়। 


          নিজে না করে অন্যকে দিয়ে কাজ করালে সুবিধা হলোঃ সেই কাজের যেকোন ভুল-ত্রূটি বের করে যে ব্যাক্তি (বা ব্যাক্তিরা) ঐ নার্সিসিস্টকে কাজটি করে দিয়েছিল, তাকে সহজেই দোষ দিয়ে দোষী বানানো যায় এবং তাকে বারবার ঐ কাজের ভূল-ত্রূটির বিষয় উল্লেখ করে/খোঁটা দিয়ে, তার মধ্যে অপরাধবোধ জাগিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনাকে হীনমন্যতায় ডুবিয়ে আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে আপনাকে এমন হেয় করবে যে আপনি নিজের পরিচয়ে নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাবেন।



          ৭) নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত একজন রোগী সবসময় চায়, সবাই তাকে আসরের মধ্যমণি হিসেবে দেখুক। সবাই তার দিকে দৃষ্টি দিক। যখনই সে দেখে অন্য কেউ তার থেকে বেশি মনোযোগ (ATTENTION) পাচ্ছে, তখনই সে নিজের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে অস্বাভাবিক কাজ শুরু করে। 


          যেমনঃ আপনি (না জেনে/চিনে) একজন নার্সিসিস্টকে বন্ধুদের সভায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই সভার মূল বিষয়ের আলোচনার প্রাক্কালে ঐ নার্সিসিস্ট চেষ্টা করবে যে কোন উপায়ে (অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গে অনর্গল কথা বলে বা সেই ঘরে থাকা কোন ছবি/ক্যালেন্ডার/স্যুভেনির ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলে বা টেবিল/চেয়ার ঠুকে শব্দ করে বা নিজে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছে, ইত্যাদি) নিজের দিকে সবার দৃষ্টি ফেরাতে।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনাকে ফাঁদে ফেলে ব্যক্তিগত/সামাজিক ভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যে আপনি মনে-মনে বা সবার সামনে চরম অপমানিত, মানসিক ভাবে আহত এবং প্রতারিত হলেও সরাসরি কাউকে ঐ নার্সিসিস্টের কোন দোষই দেখাতে পারবেন না, মনে হবে সব দোষই আপনার নিজের।



          ৮ ) আপনি মানেন বা না মানেন, একজন নার্সিসিস্ট মনে-প্রানে বিশ্বাস করে সে সবার থেকে বড় (SUPERIOR COMPLEX)। প্রথমদিকে সে আপনার সাথে বর্ণচোরা বন্ধুবেশে মেলামেশা শুরু করলেও তার কথা এবং কাজে আপনি প্রমান পেতে শুরু করবেন যে একজন অসুস্থ নার্সিসিস্ট। 


          সে নিজেকে সবকিছুতেই সর্বজ্ঞানী (EXPART) হিসেবে উপস্থাপন করে চেষ্টা করবে আপনাকে নিজের মতো করে পরিচালনা করে কাজ করাতে। আপনি যদি তাকে সম্পুর্ন অজানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে না জানলেও বলবে সে জানে তবে আজ নয় পরে বলবে। যাতে করে তার দিকে আপনি মনোযোগ (ATTENTION) দিয়ে রাখেন।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্টকে সনাক্ত করতে পেরে আপনি আপনার কোন কাজে তাকে বাধা দিলেও সে কিছুটা বিরতি নিয়ে সময় বুঝে অন্য ভূমিকা/চরিত্র'এর বেশ ধরে আপনার কাছে সেই পুরনো রাগ নিয়ে ক্ষতি করতে বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করবে। সে আপনাকে অর্থ-সম্পত্তির প্রলোভন দিতেও পিছপা হবে না। তাকে সুযোগ দেবেন তো তার ফাঁদে ধরা পরবেন।  



          ৯) অন্যকে প্রভাবিত (MANUPULATE) করতে একজন নার্সিসিস্টের খুবই কমন ডায়লগ হলো, 'আর ক'দিনই বা বাঁচব?' বা 'আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা' বা 'আর কোন দিন তোমাকে বলব না' বা 'নিজের কাল্পনিক শারিরীক অসুস্থতার অজুহাত' বা 'তোমার বয়সে আমি এটা/সেটা করেছি' বা 'তোমার জায়গায় আমি হলে এটা/সেটা করতাম' বা 'আমার নিকটাত্মীয় মারা গেছে বলে কোন সুবিধা আদায়' বা 'আগামী অমুক বিশেষ দিনের পরে এই কাজ শুরু করবো (মিথ্যা অজুহাত)' ইত্যাদি। 


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট খুবই আত্মকেন্দ্রিক। তার সবকিছুই সে নিজে কি ভাবে, কি চায়, কি অনুভব করে ইত্যাদি ঘিরে। তার সঙ্গে যে'ই থাক না কেন তার/তাদের মতামত-ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছুই তুচ্ছ। 



          ১০) নার্সিসিস্টরা সবসময় মিথ্যাবাদী। তাদের পুরো দুনিয়াটাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের কাজে এবং কথায় সহজেই এটি ধরা যায়। খুবই নীচ স্বভাবের কারনে চুরি করে/ইচ্ছা করে/আড়ি পেতে কারো (বিশেষ করে পরিবারের কাছের মানুষদের) গোপন বিষয় (পোষাক বদল,গোসল, একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়/সময়) দেখা/ছবি তোলা, অন্যের ব্যক্তিগত চিঠি-ডায়েরী আত্মসাৎ করা এবং সেগুলি পড়া এবং পরবর্তী সময়ে তার শিকার/(VICTIM)-কে জানানো যে সে তার গোপন বিষয়গুলি জানে, ইত্যাদি একজন নার্সিসিস্টের জন্য খুবই সাধারন ব্যাপার।


          এ ভাবে একজন নার্সিসিস্ট তার শিকার/(VICTIM)-কে সবার সামনে বা গোপনে লজ্জাজনক/ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতিতে ফেলে ব্ল্যাকমেল করে গোপনে/সবার সামনে ছোট করে/(DOMINATE) তাকে নিয়ন্ত্রণ/ (CONTROL) করার চেষ্টা করে।


          মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনার কষ্ট দেখে-শুনে আনন্দ পায় এবং এই কারনেই সে আপনার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে যাতে আপনি যেভাবেই হোক যেন কষ্ট পান। এটিই তার বিনোদন। বন্ধু-শুভাকাংখী-পরোপকারীর ভুমিকায় এসে সবসময় সে আপনার সুবিধার চেয়ে অসুবিধা-সমস্যার কথা বেশি শুনবে এবং কোন বাস্তব সমাধান না দিয়ে সবজান্তার ভান করে সেগুলি নিয়ে ডিটেইল আলোচনা করবে যাতে করে মনে মনে সে নিজেকে আপনার চেয়ে সুখি তুলনা করে আত্মতৃপ্তি পায়। তার সাথে আপনার সুবিধার কথা আলোচনা করলে সে চেষ্টা করবে সেগুলি যে ভাবেই হোক নষ্ট করার এবং আপনার কাছ থেকে সরিয়ে নিজে পাবার।



          নিশ্চয় আপনি বুঝে গেছেন কিভাবে একজন নার্সিসিস্টকে চিহ্নিত করা যায়। 


          আসুন এখন দেখি কেন একজন মানুষ নার্সিসিস্টে পরিনত হয় এবং কিভাবে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।



          প্রত্যেক মানুষের জীবনেই শৈশব, বয়ঃসন্ধি এবং কৈশোর তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে খুব বড় ভূমিকা রাখে। যে ব্যক্তি শৈশব থেকে পরিবারে খুব আদরে এবং অন্যের কাছ থেকে খুব বেশি মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত, তারা বড় হয়েও সেই আদর এবং মনযোগের কাঙ্গাল হয়। আবার যারা একেবারে অনাদরে এবং অমনোযোগে বেড়ে ওঠে, তারাও বড় হয়ে অন্যের কাছ থেকে আদর এবং মনোযোগ পাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বড় হবার পর সমাজে যখন সে নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশি দাম পায় না, তখন সে নিজের হীনমন্যতা ঢাকতে - নিজের কাল্পনিক দাম পেতে পরিবার, কাছের মানুষ এবং সদ্য বা স্বল্প পরিচিতদের সাথে মনের খেলা (MIND GAME) শুরু করে প্রভাবিত করে নিজের কাল্পনিক দাম  বাড়ানো/আকর্ষনের কেন্দ্র হতে চেষ্টা করে। মূলত, এ কারনেই একজন নার্সিসিস্টের জন্ম হয়। 


          সেই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বভাব, রুচি, অভ্যাস, পরিবার, সামাজিক পরিবেশ দিনে-দিনে তাকে মানুষের শরীরের আড়ালে মানসিক ভাবে অমানুষে পরিনত করে। একজন নার্সিসিস্ট কিছুতেই বুঝতে পারে না অন্য মানুষদেরকে (বেশিভাগ ক্ষেত্রে নিজ পরিবারের সদস্যদের উপর এবং কর্মক্ষেত্রে অধঃস্থনদের উপর) মানসিক অত্যাচার - অকারনে হয়রানি, কাজের ছেলে/মেয়েদের - সন্তানদের - আশ্রিতদের বেধড়ক মারপিট, পোষা প্রানীদের উপর অকারনে অত্যাচার বা মেরে ফেলা ঠিক না। তার মধ্যে অন্য যেকোন জীবের প্রতি কোন দয়া (PITTY), সহানুভূতি (SYMPATHY) এবং সহমর্মিতা (EMPATHY) কাজ করে না। 


          জন্মগতভাবে যখন এই মানবিক বোধগুলি/ মানবীয় গুণাবলী একজন নার্সিসিজম রোগীর মধ্যে থাকেনা তখন সে একজন সাইকোপ্যাথ (PSYCHOPATH)'এ পরিণত হয়। আর যখন সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে এই মানবিক বোধগুলি/ মানবীয় গুনাবলী একজন নার্সিসিজম রোগীর ভিতর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তখন সে সোশিওপ্যাথ (SOCIOPATH) 'এ পরিণত হয়। 


          যেহেতু মানসিক রোগ নার্সিসিজমের কোন ঔষুধ এবং প্রতিকার নাই এবং অন্যের অবেগ, অনুভূতি এবং মন নিয়ে খেলা করাই অসুস্থ নার্সিসিজম রোগীর প্রধান কাজ সেহেতু তাকে চিহ্নিত করতে পারলেও তাকে সারাতে/ চিকিৎসা/ বলতে যাবেন না যে সে মানসিক রোগী। হিতে বিপরীত হবে। যদি পরিবারের মধ্যেই নার্সিসিস্ট থাকে তবে চেষ্টা করুন তার সাথে যত কম লেন-দেন, মেলা-মেশা, কথা বলা বা যে কোন বিষয়ে শেয়ার করা যায়। 


          মনের ভিতরে একজন ভিরু-হীনমন্য-নীচ এবং অত্যাচারী নার্সিসিস্টের বাইরের চরিত্রের সবকিছুই তার মুখোশ। আর সেই মুখোশ দেখতে তার আয়নার প্রয়োজন। আপনার উপর তার মানসিক খেলা/ (MIND GAME)’এর প্রতিফলন এবং প্রভাবই হলো সেই আয়না, যার মাধ্যমে সে নিজেকে আপনার নিয়ন্ত্রক হিসেবে অনেক বড় করে দেখে। 


          চেষ্টা করুন একজন নার্সিসিস্টকে সম্পূর্নভাবে এড়িয়ে চলতে। ব্যাক্তিগতভাবে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এড়িয়ে চলুন। সহানুভূতি নিয়ে সাহায্য করার জন্য একজন নার্সিসিস্টের পাশে দাঁড়াবেন তো তার ফাঁদে ধরা পরবেন।


          29 June 2020

          কম্বোডিয়া ভ্রমনঃ ঘুরে এলাম WAT PHNOM


          কোভিড-১৯ এর আমলে ভ্রমন মানেই হ্যাঁপা। মহামারীর ভয়ে কোন দেশে ঢোকা বারন আবার একবার ঢুকলে বেরোনো আরো শক্ত। অনেকের কাছে কম্বোডিয়া ভ্রমনের তালিকায় একেবারে নীচের দিকের দেশ হলেও সম্প্রতি চীনের ‘রোডস এন্ড বেল্ট’ কর্মসূচীর আওতায় এখানের উন্নতি চোখে পরার মতো। অসংখ্য হাইরাইজ বিল্ডিং আর চীনা নাগরিকদের ভিড়ে সাদা চামড়ার পর্যটকদের আনাগোনাও প্রায় সবখানে। মূলতঃ ‘থাই’ আতিথিয়তায় হাপিয়ে কিছুটা জিড়িয়ে নিতেই তাদের কম্বোডিয়া আসা। তবে সম্পূর্ন বিদেশি অর্থ সহযোগীতা এবং বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে চলা অর্থনীতির এই দেশ কম্বোডিয়ায় বিদেশিদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অভিযোগ এবং প্রশ্ন তোলে অনেক বিদেশি পর্যটকরাই।






          রাশিয়ার রাজধানী মস্কো যেমন মস্কোভা নদীর তীরে অবস্থিত তেমনি কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন ‘টনলে সাপ, মেকং এবং বাস্‌সাক’ এই তিন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এই শহর প্রতিষ্ঠার মুখে-মুখে প্রচলিত লৌকিক কাহিনী এইরকমঃ বুড়ি ‘পেন’(Penh) এই তিন নদীর মোহনার ঘাট থেকে একটি গাছ ভেসে যেতে দেখে। সে আরো দেখে যে, ঐ গাছের শেকড়/ডালে ছোট চারটি বুদ্ধের মূর্তি আটকে আছে। ঐ বুড়ি বৌদ্ধমূর্তিগুলি উদ্ধার করে একটি মাটির টিলার উপর প্রতিষ্ঠা করে এবং পূজা শুরু করে। এক পর্যায়ে ঐ মূর্তি ঘিরে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এবং রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দিরের ব্যাপক উন্নতি হয়। বুড়ি ‘পেন’ এর নামে শহরের নাম হয় ‘নমপেন’। অনেক কাহিনীতে বুড়ি ‘পেন’কে ধনী বিধবা আবার কোথাও দাদী হিসেবে ডাকা করা হয়েছে।


           




          গত সপ্তাহে বিকেলে হঠাৎ করেই আবারও দেখতে গেলাম সেই বুড়ি পেন এর প্রতিষ্ঠিত মন্দির ‘ওয়াট ফ্‌ন্‌ম’। বাংলা ভাষায় উচ্চারনগত জটিলতার কারনে Phnom Penh কে নমপেন বলা হলেও এখানে সবাই আমরা বলি ফ্‌ন্‌ম পেন। সেই কারনে মন্দিরের নাম Wat Phnom কে ওয়াট ফ্‌ন্‌ম - ই বলতে হবে। আর হ্যাঁ, খেমার/কম্বোডিয়ান ভাষায় Wat মানে প্যাগোডা (বৌদ্ধ মন্দির)। যে টিলার উপর মন্দির, তার চারপাশ ঘিরে সুন্দর গোল চত্বর, পার্ক এবং রাস্তা।






          মেইন গেটে চোখে পড়ল সিকিউরিটির লোকজন এক নববিবাহিত চীনা দম্পতিকে প্যাগোডায় উঠতে নিরুৎসাহিত করছে। কাছে যেতে শোনা গেল তারা ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজীতে তাদের থেকেও ভাঙ্গা-ভাঙ্গা ইংরেজীর কম্বোডিয়ান মন্দির সিকিউরিটির কাছে তাদের কম্বোডিয়া হানিমুন ট্রিপ এবং Wat Phnom ভিজিটিং প্ল্যান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। তবে এক পর্যায়ে কোভিড-১৯ এবং এর কারনে পর্যটকদের বিধিনিষেধ তাদের বোঝানো হলে তারা চলে যায়।






          ঠিক কী কারনে জানিনা সিকিউরিটির লোকজন আমাকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত ১ ডলারের টিকিট কেটে মন্দিরে ওঠার অনুমতি দিলেও তাদের থ্যাংকস জানিয়ে সিঁড়ি দিয়ে অত উপরে ওঠা-নামার ঝামেলায় না যেয়ে সিদ্ধান্ত নেই শুধু নিচের পার্কেই সময় কাটানোর। আমার মূল আকর্ষনের কেন্দ্র ছিল পার্কের মাঠে রাজার মূর্তির সামনে অতি বিশালাকায় একটি ঘড়ি। পার্কে গিয়ে আমার মতোই ঘড়ি দেখতে উৎসাহী কিছু কম্বোডিয়ান ভ্রমনপিপাসুদের দেখলাম সেলফি তুলতে ব্যস্ত।





          প্রায় এক বছরের উপর হলো প্রথমবার এসেছিলাম এই প্যাগোডা দেখতে। নমপেন’এর এই অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সেই সময় ছিল বিদেশি পর্যটকদের কোলাহলে মুখরিত। মাটি থেকে প্রায় ৮০ ফিটের বেশি উপরে টিলায় অবস্থিত এই প্যাগোডার বাহির এবং ভিতরের নিপুন হাতের কারুকাজ একবার হলেও চোখে দেখার মতো। তাই শারিরীক প্রতিবন্ধকতার তোয়াক্কা না করে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় শরীরের শক্তির চেয়ে মনের উৎসাহই বেশি প্রাণশক্তি যুগিয়েছিল।





          মূল মন্দির টিলার শীর্ষে অবস্থিত হলেও ঠিক মাঝামাঝি আরেকটি মন্দির অনেক পরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেটি মূলত এখানে বসবাসকারী এবং ভ্রমনরত চীনা নাগরিকদের আকর্ষন করতে। মজার ব্যাপার হলো চীনাদের টার্গেট করে বানানো এই মন্দিরে কম্বোডিয়ানদের উপচে পরা ভিড়। সচারচর চীন দেশের মন্দিরগুলোতে শান্তির দেবী কুওনাইন (হিন্দু ধর্মমতে - দেবী সরস্বতী) -এর পূজা করা হয়, কিন্তু Wat Phnom - এর এই চীনা মন্দিরে পূজা করা হয় চীনা পূরানের যুদ্ধবাজ দেবতাদের (Chinese Mythological Warlord)। খেয়াল করে দেখেছিলাম, মন্দিরে শান্তি বা যুদ্ধ যে দেব-দেবীর’ই পূজো করা হোক না কেন মূর্তির পায়ের কাছে রাখা সব দান বাক্সই ছিল টাকায় ভর্তি আর বড় নোটগুলি সবার সামনে সরাসরি চালান হয়ে যাচ্ছিল কাছে থাকা সেবায়েতদের পকেটে। আমি ঐ সময় আবারো উপলব্ধি করেছিলাম, প্রার্থনায় ভক্তের ভক্তিই প্রধান আর বাঁকী সব নিমিত্ত মাত্র।









          ব্যস্ত শহরের মাঝে সবুজে ঘেরা সুন্দর এই পার্কে নতুন করে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সময় কিভাবে পার হয়ে বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত হলো টেরই পেলাম না। তবে নতুন করে স্মৃতিতে থেকে গেল আরো কিছু স্মরণীয় মূহুর্ত এবং ছবিতে।


          12 May 2020

          কম্বোডিয়া ভ্রমনঃ সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং শুভ জন্মদিন

          একটানা ১৩ বছর প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশে বসবাসের পর এখন রাজা-বাদশাহদের দেশে বসবাস করার মজাই আলাদা। বিষয়টি আরো মজার যখন রাজা-বাদশাহদের সম্মান বা মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি আইন জারি করে মতামতের তোয়াক্কা না করে জনগনের উপর আরোপ করা হয়। ‘সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে’ রাজা নির্বাচিত সরকারের না নির্বাচিত সরকার রাজার পাপেট তা বোঝা মুশকিল। তবে নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব এবং দেশের প্রতি ভালবাসা থাকলে একই দেশে রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র একই সঙ্গে দেশ শাসন এবং পরিচালনা করতে পারে।


          সিংহাসনে রাজা মহামান্য নরোদম সিহামনি


          পৃথিবীর আরো অনেক দেশের মতো কম্বোডিয়াও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের একটি দেশ। অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ পদমর্যাদাধারী রাজা এবং তার অধীনে জনগনের নির্বাচনে প্রধানন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীপরিষদ এবং সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হয়। ইংল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন, জাপান, থাইল্যান্ড সহ আরো অনেক দেশে এই রকম শাসন ব্যাবস্থা দেখা যায়।


          পিতা মাতার সঙ্গে রাজা মহামান্য নরোদম সিহামনি


          গতানুগতিক ধারায় রাজতন্ত্রে রাজা/রানি/বাদশাহ মানেই অত্যাচারী-স্বৈরাচারী সহ ইত্যাদি নেতীবাচক বিষয় এবং শুধুমাত্র গণতন্ত্রেই মুক্তি সহ নানাবিধ ইতিবাচক বিষয় সুবিধা অনুযায়ী জনগনের মাথায় গেঁথে দেওয়া হলেও কে কোন তন্ত্র জনগনের উপর কিভাবে প্রয়োগ করবে তার মাধ্যমেই জনগনের মূল স্বার্থকতা। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, কার্জকর বিচার ব্যাবস্থা, আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ, শিক্ষিতের হার (স্বাক্ষরতার হার নয়), কর্ম-সংস্থানের হার (বেকারত্বের হার নয়), ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিক এবং মুক্ত চিন্তা ভাবনার সুস্থ এবং সুষ্ঠ প্রয়োগের উদাহরন উল্লেখযোগ্য।




          ভূমিকার অবতারনার পর মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। কম্বোডিয়ার প্রয়াত রাজা মহামান্য নরোদম সিহানুক’এর পুত্র বর্তমান রাজা মহামান্য নরোদম সিহামনি ১৯৫৩ সালে ১৪ ই মে জন্মগ্রহন করেন। ২০০৪ এর পর থেকে তিনি সিংহাসনে অভিষিক্ত হলে রাজার এই জন্মদিনে প্রতিবছর সরকারী ছুটি পালন করা হয়। চেক প্রজাতন্ত্রে শিক্ষাগ্রহনের পর তিনি ইউরোপে সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি শাস্ত্রীয় নৃত্যের একজন খ্যাতিমান প্রশিক্ষক।




          রাজপুত্র বলেই তিনি রাজা হয়েছেন বিষয়টি ঠিক তা নয়। তাঁকে ‘রাজ সিংহাসন পর্ষদের’ ভোটের মাধ্যমে জয়ী হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করতে হয়। এই কারনে তিনি পৃথিবীর দূর্লভ 'নির্বাচিত রাজা'দের একজন। বর্তমান সময়ে তাঁকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে জনগনের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, সংসদ সদস্য এবং জনগনের সাথে একসঙ্গে উপভোগ করতে দেখা যায়। খুবই বিনয়ী রাজা নরোদম সিহামনি কম্বোডিয়ার জনগনের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত এবং জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব।




          কম্বোডিয়ার রয়্যাল প্যালেস বা রাজপ্রাসাদ নমপেনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। অসংখ্য বিদেশী পর্যটকদের সাথে সাথে স্থানীয় মানুষজনের ভীড় এইখানে চোখে পড়ার মতো। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশের নির্দিষ্ট সময় এবং টিকেটের মূল্য বেধে দেওয়া থাকলেও বাইরের প্রাঙ্গন সবার জন্য উন্মুক্ত। মেকং (Mekong River), টনলে সাপ (Tonle Sap River) এবং বাস্‌সাক (Bassac River) এই তিন নদীর সংযোগস্থলের পাড়ে এই রাজপ্রাসাদের অবস্থানের কারনে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এইখানে শত-শত মানুষ প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনের জন্য বেড়াতে আসে।




          এই রাজপ্রাসাদ এবং সংলগ্ন এলাকা আমার কাছে নমপেনে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে পছন্দের জায়গার অন্যতম। যারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন’এ আসবেন আশা করছি তারাও এই এলাকা ভ্রমন করবেন। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে বসবাস করেও জনগন কিভাবে অন্যান্য ‘তন্ত্র’র চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছে তা কম্বোডিয়াতে এসে দেখার মতো।




          28 August 2011

          নববর্ষ ১৪১৪ ' মস্কো

          প্রথম প্রকাশঃ ১৫/৪/২০০৭


          মহা সাড়ম্বরে মস্কো' তে বাংলাদেশী ছাত্রসংগঠন গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় রাশিয়া 'র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো বাংলা বর্ষবরণ ১৪১৪। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ তঃক্লাব মিলনায়তনে তিনঘন্টা ব্যাপী অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথিরা ছিলেন ডেপুটি চীফ অফ মিশন বাংলাদেশ রেজিনা আহমেদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-রেক্টর আ.ভ . এরমাকভ, চেম্বার অফ কমার্স রাশিয়া এর সভাপতি রফিকুল ইসলাম আরজু মিয়া, বাংলাদেশী ছাত্রসংগঠনের সভাপতি কাজী শিবলী সুমন এবং এশিয়ান ছাত্রসংগঠনের সভাপতি বিপ্লব চন্দ্র সাহা।




          কোরান তেলয়াত, জাতীয় সঙ্গীত এবং বিশেষ অতিথিদের ভাষনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সবাই পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে যেয়ে নতুন বছরে নব উদ্দীপনায় সামনে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানান। বাংলায় শুভ নববর্ষ, ইংরেজীতে হ্যাপী নিউ ইয়ার এবং রাশিয়ান ভাষায় স্নোভিম্‌ গোদাম্‌ বলে সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে অভ্যাগত বিদেশি অতিথিবৃন্দ এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝার সুবিধার্থে ডেপুটি চীফ অফ মিশন বাংলাদেশ রেজিনা আহমেদের ভাষন রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠ করা হয়।

          বাংলাদেশী এবং রাশিয়ান ভাষায় চমৎকার অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় শুরু হয় মূল পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজেশ, জুয়েল এবং মাহবুবের বাংলা গানের পাশাপাশি বিদেশি শিল্পীদের পরিবেশিত হিন্দী, মারাঠী, পাঞ্জাবী, আরবী, ল্যাটিন, রাশিয়ান এবং ইংরেজী নাচ আর গানে মেতে ওঠে মিলনায়তন। মূহুর্মূহু করতালির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় অতিথিদের উচ্ছ্বাস। এটি বাঙ্গালী বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হলেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশী অতিথি এবং ছাত্র-ছাত্রী । মিলনায়তনে উপস্থিত সবার জন্য আপ্যায়নের ব্যাবস্থা ছিল অনুষ্ঠানের বাড়তি চমক।

          রুশ ভাষায় পড়াশুনা

          প্রথম প্রকাশঃ ২৩/৩/২০০৭


          এই সেমিস্টারে প্রতি সপ্তাহে আমাদের দুই দিন রুশ ভাষা ক্লাশ হচ্ছে। যদিও সব সাবজেক্ট রুশ ভাষাতেই পড়তে হয়, তবুও এই দুইদিন ক্লাশে যেতে সব বিদেশী ছাত্রদের খুব অনিহা। কারন বোধহয় দুর্বোধ্য রুশ ব্যাকরন। দেশে যখন বাংলা ব্যাকরন পড়তাম, ভাবতাম এরচেয়ে কঠিন কোন বিষয় বুঝি আর নেই। সেই কারনে সেটা ভাল করে শেখা হয়নি। আমার লেখায় অসংখ্য ভুলে ভরা বানান দেখে সেটা সহজেই অনুমেয়। এখন ভিনদেশী ব্যাকরন শিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে বরং ভাল করে বাংলা ব্যাকরন শেখাটাই উচিৎ ছিল।


          তবে ইউনিভার্সিটি চেষ্টা করে বিদেশি স্টুডেন্টদের যতটা সম্ভব আকর্ষনীয় ভাবে তাদের ভাষা শেখানোর। তাই মাঝে মাঝে আমাদের সভিয়েত আমলের সিনেমা দেখান হয়। এবং শেষে ব্যাখ্যা করতে হয় সিনেমার বিষয়। এখন আমরা বিখ্যাত রুশ লেখক “চেখভ্‌” এর “দামা স্‌ সাবাচ্‌কেয়’’ নামের একটি বই পড়ছি। এই বইটির নামের বাংলায় অনুবাদ দাঁড়ায় “কুকুরসহ ভদ্রমহিলা”। এই গল্পের প্রধান চরিত্র একজন ভদ্রমহিলা যার ছোট্ট একটি সাদা কুকুর আছে। বইটি শেষ করে আমরা এই সিনেমা দেখব। “চেখভ্‌” এর গল্প লেখার স্টাইল খুবই আকর্ষনীয়। এত পুরোনো লেখক হলেও তাঁর অত্যাধুনিক মনমানসিকতা অবাক করার মত। রুশ ভাষায় রুশ সাহিত্য পড়ার মজাই আলাদা। অনুবাদ করে কোনো ভাষার সাহিত্যরই আসল স্বাদ পাওয়া যায়না।

          “মিক্সড্‌ কালচার, মিক্সড্‌ ফুড”

          প্রথম প্রকাশঃ ২১/৩/২০০৭

          আমি যে হোস্টেলে থাকি, সেটা আমাদের ইউনিভার্সিটির অন্যান্য হোস্টেলের মত না। তার আগে বলে নেই আমাদের সাধারন হোস্টেলগুলোর প্রত্যেকটির মেইন বিল্ডিং ৫ তালা করে। আর বাঁকী গুলো ১৮ তালা করে। সেগুলোর মধ্যে আবার আমার হোস্টেলটা আবার ভি,আই,পি টাইপের। অর্থাৎ এপার্টমেন্ট সিস্টেম। আমার এপার্টমেন্টে চারটি রুম। তার একটাতে থাকি আমি আর বাঁকীগুলোতে থাকে চায়নীজ, জ্যামাইকা আর কলম্বিয়ার ছেলেরা। আমাদের সবকিছুই আলাদা হলেও কিচেন একটাই। তাই গত তিন বৎসর ধরে একসাথে রান্না করতে করতে তাদের খাবার সম্বন্ধে আমার ভাল ধারনা হয়ে গেছে। এপার্টমেন্টে ঢুকে গন্ধ শুকেই বুঝতে পারি কোনদেশী রান্না হচ্ছে।


          দুই রুমে চারজন চায়নীজ স্টুডেন্ট থাকে তাই তাদের প্রসঙ্গে আগে লিখছি। তারা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশীদের মতই ভাত খায়। সেই সংগে ন্যুডলস্‌, মাংস, সব্জী আর মাঝে মাঝে মাছ। তাদের রান্নার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। খাবার আমাদের মত অতটা সিদ্ধ করেনা। প্রথমে ফ্রাইংপ্যানে তেল খুব গরম করে তাতে ছোট করে কাটা মাংসের টুকরো ছেড়ে ভেজে নেয়। তাতে সামান্য পানি দিয়ে পাঁচ-ছয় মিনিট গরম করে নেয়। তারপর সেই গরম পানিতে সব্জি, লবন আর মিক্সড্‌ মশল্লার গুড়ো দিয়ে আরো পাঁচ মিনিট সিদ্ধ হলেই তাদের রান্না শেষ। তাদের সেই মিক্সড্‌ তরকারি ভাত দিয়ে কিংবা সেই গরম তরকারিতেই ন্যুডলস্‌ ছেড়ে স্যুপের মত করে খায়। আমি নিজের খাবার নিজেই রান্না করি বা কখনও ফ্রেন্ডস্‌রা মিলে একসাথে। মোটামুটি একই উপকরন দিয়ে যদি আমি/আমরা আর চায়নীজরা রান্না শুরু করি, তাহলে আমাদের রান্না অর্ধেক হতে হতে তারা খাওয়া শেষ করে থালা-বাসন ধুয়ে সব কমপ্লিট্‌। বাংলাদেশে যেসব চিয়নীজ হটেল আছে, সেগুলোর খাবারের থেকে এই খাবারের স্বাদ একেবারেই আলাদা। অরিজিনাল চায়নীজ খাবার। আমি তাদের খাবার খেয়ে দেখেছি, স্বাদ আমাদের থেকে সামান্য আলাদা হলেও খারাপ না। এককথায় সুস্বাদু।

          এবার আসি জ্যামাইকান্‌দের খাবারের কথায়। তারাও প্রায় সবসময় ভাত খায়। প্লাস্‌ মাংস। আমি তাদেরকে খুব কম সময় মাছ খেতে দেখেছি। রান্না প্রায় আমাদের মতই। তবে খুব ঝাল খায়। মাঝে মাঝে তারা মাংসের সাথে সিদ্ধ আলু আর সিদ্ধ আটা/ময়দা খায়। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করছি, তারা প্রথমে আটা/ময়দাকে পানি দিয়ে মাখিয়ে মন্ড তৈরী করে। আমরা রুটি বানানোর জন্য যেমনটি করি তেমন। তারপর হাত দিয়ে গোল গোল ছোটো টুকরো করে নেয়। সেই ছোটো টুকরোগুলোকে চ্যাপ্টা করে টগবগে গরম পানিতে ছেড়ে প্রায় একঘন্টা ধরে সিদ্ধ করে। তাদের কাছথেকে শুনেছি যে, এই খাবারে নাকি প্রচুর এনার্জি।

          কলম্বিয়ানদের খাবারও প্রায় আমাদের মতই। ভাত আর মাংস। তবে তারা প্রায় সব তরকারীতেই লাল বা সাদা বীন (এক জাতীয় শিমের বিচী) ব্যাবহার করে।

          এবার আসি আমার খাবারে। আমি “না ঘরকা না ঘাটকা”। ঐসব মিক্সড্‌ কালচারের খাবার দেখে আমি একধরনের মিক্সড্‌ খাবার তৈরী করি। যদিও ঐ খাবারের প্রায় অনেকটাই বাংলাদেশী খাবারের মত। মেন্যুতে আছে ভাত, মাংস, মাছ আর সব্জী। আর আমার সবচেয়ে খানদানী খাবার হলো আলুভর্তা আর ডিমভাজা। আলু ছোট কুচিকুচি করে কেটে, বেশী করে পেয়াজ আর কাঁচা মরিচ ফালি করে কেটে দিয়ে কেচ্‌কী মাছের চচ্‌চরি খেতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু এই রাশিয়াতে এখনও সেই সুযোগ আসেনি। হয়তো খুব শীঘ্রই আসবে। সেই সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।
          [বর্তমান আপডেটঃ সুযোগ এসেছে কিন্তু খুব কম। :)]

          “উই লাভ বাংলাদেশ, উই লাভ ক্রিকেট”

          প্রথম প্রকাশঃ ৯/৪/২০০৭ দৈনিক যুগান্তর।






          পড়াশুনা এবং বসবাসের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বাংলাদেশীরা অবস্হান করছেন। তেমনি প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমানের রাশিয়ান ফেডারেশনেও বসবাস করছেন বেশ কিছু বাংলাদেশী। এদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখাই বেশী।

          বাংলাদেশ থেকে আগত ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকাংশই পড়ছেন রাজধানী মস্কোতে অবস্থিত "রাশিয়ার গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্দ্যালয়ে"। অন্যান্য ইউনিভার্সিটি এবং স্টেটে তুলনামূলক কম বাংলাদেশীদের অবস্হানের কারনে এই ইউনিভার্সিটিকে বাংলাদেশী কম্যূনিটির প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়।

          ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে অন্যান্য দিনের মতই 17'ই মার্চের সকাল শুরু হলেও প্রতিটি বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ। আমাদের দেশে প্রতিটি ক্রিকেট দলভূক্ত দেশের আলাদা সমর্থক থাকলেও মস্কোর প্রবাসী বাংলাদেশীদের ছিল একটাই ফেভারেট দল "বাংলাদেশ"।

          যেহেতু রাশিয়ায় ক্রিকেট খেলা তেমন জনপ্রিয় নয়, সেহেতু স্হানীয় টিভি চ্যানেলের উপর ভরসা না করে অধিকাংশই খেলা উপভোগ কোরেন স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং ইন্টারনেটে। খেলা চলাকালীন সময়ে যারা টিভি বা কম্পিউটারের সামনে বসার সুযোগ পাননি, তারা মোবাইল ফোনে শুনে নিচ্ছিলেন "স্কোর"। বাংলাদেশী "টাইগার"দের প্রতিটি রান এবং ভারতের প্রতিটি উইকেটের পতনে বাংলাদেশী ছাত্রদের উল্লাসে কেঁপে উঠছিল ইউনিভার্সিটির আবাসিক হোস্টেলগুলো। অন্যান্য দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা যারা ক্রিকেট বোঝেন এবং ভালবাসেন, তারাও যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশীদের আনন্দে।


          বাংলাদেশ জেতার প্রায় সংগে সংগেই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস সংলগ্ন "মিকলুখো মাকলায়া" রাস্তায় বিজয় মিছিলে নেমে পরে প্রতিটি বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী। বাইরে তখন মাত্র এক (1') ডিগ্রী তাপমাত্রা। মধ্যরাতে লাল সবুজের পতাকা এবং ঊল্লাসধ্বণীতে মুখরিত হয় পূরো উইনিভার্সিটি এলাকা। ক্যাম্পাসে বসবাসরত উৎসূক রাশিয়ান এবং বিদেশীরাও জেনে নিচ্ছিলেন আনন্দের কারন। বাংলাদেশীদের হৃদয়ের উষ্ণতায় তারাও যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিজয় মিছিলে। আর সবার মুখে ছিল একটাই স্লোগান: "উই লাভ বাংলাদেশ, উই লাভ ক্রিকেট"।

          শেয়ার করুন

          Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More