‘নার্সারী’ নামটি শুনলে গাছ-পালা-ফুলের বাগান বা ছোট বাচ্চাদের স্কুলের কথা মনে হলেও এর পেছনের কাহিনী একটু ভিন্ন। গ্রীক পুরাণে একজন শিকারী ‘নার্সিসাস’ নিজের রূপে এতই মগ্ন ছিল যে (ঐ সময় আয়না ছিলনা তাই) সব সময় পানির কাছে গিয়ে বিভোর হয়ে নিজের প্রতিফলন দেখত। দেবতা নেমেসিস'এর অভিশাপ তাকে পানির ধারের ছোট গাছে পরিণত করে দেয় (যাতে সে সারা জীবন পানিতে নিজের প্রতিফলন দেখতে পারে)।
আমাদের খুব প্রিয় রজনীগন্ধা হলো সেই ফুল গাছের আরেক রূপ যার নাম নার্সিসাস। দেবতা নার্সিসাস এর রূপান্তর আমাদের খুব প্রিয় একটি ফুল গাছ বা ফুলে হলেও এর অপর পিঠের রূপ খবই ভয়ংকর একটি রোগ। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই রোগের নাম নার্সিসিজম (NARCISSISM)। যার কোন ঔষুধ/প্রতিকার/নিরাময় আজও আবিষ্কার হয়নি।
অসুখের নামটি যতই খটমট শোনাক না কেন, একটু খেয়াল করলেই আমাদের আশেপাশের খুব কাছের মানুষদের মধ্যে এই রোগের প্রায় সব লক্ষন সহজে চিহ্নিত করা যায়। নার্সিসিস্ট (NARCISSIST)'রা
(নার্সিসিজম রোগে আক্রান্তদের নার্সিসিস্ট বলে) সব সময় চায় তাদেরকে কেন্দ্র করে সব কিছু আবর্তিত হোক। তারা সব সময় চায় ছলে-বলে-কৌশলে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করতে। অন্যকে কোন ভাবেই তারা ভাল কাজের ক্রেডিট দিতে চায় না।
কিন্তু তাদের এই আত্মকেন্দ্রিকতা ঠিক 'ঘরকুনো/INTROVERT' স্বভাবের না বলে এবং এরা 'বাইরে ঘুরে বেরানো/EXTROVERT' স্বভাবের বলে এদের চিহ্নিত করতে-করতে এরা ঠিক আপনার ক্ষতি করে ফেলে। এই সব নার্সিসিজম রোগীদের কথা-বার্তা-কাজ-কর্ম এমন চমকপ্রদক/ক্যারিশমাটিক (CHARISHMATIC) অথবা সহানুভুতিশীল/SYMPATHETIC যে আপনি কবে-কখন-কিভাবে এদের শিকার/VICTIM - হয়ে তাদের হাতের খেলার পুতুল/PUPPET-এ পরিণত হয়ে গেছেন টেরই পাবেন না।
তাই নিজের ক্ষতি হবার আগেই আসুন জেনে নেই খুব সহজেই কিভাবে এই ভয়াবহ মানসিক রোগের রোগী নার্সিসিস্টদের চিহ্নিত করা যায়।
১) নার্সিসিস্টদের নিজের যা'ই থাক না কেন তা খুব বড়াই করে সবার কাছে সরাসরি এবং আকারে ইঙ্গিতে সব সময় প্রচার করে বেড়ায়। প্রয়োজনের খাতিরে বা প্রসঙ্গ/সময় বুঝে আমরা সবাই নিজেদের কথা অন্যকে বললেও, তারা সব সময় নিজের ছোট-বড় সব কিছু অন্যের কাছে খুব বড়াই করে বলে বেড়ায়। অন্য কথায় বলা যায় 'নিজের ঢোল নিজে পেটানো'।
একজন নার্সিসিস্ট যদি ৩০ বছর আগে আপনাকে এক কাপ র' চা খাওয়ায় তা আজও নিজের ক্রেডিট নিতে এবং একই সাথে আপনাকে ছোট করতে আপনার চেনা-অচেনা সবাইকে বলে বেড়াবে।
উদাহরনঃ
- আরে 'অমুক'কে চেন না?
- ঐ যে ১৯৯০ সালে আমার কাছে এক কাপ র'চা খেয়ে গেল।
- এত কষ্ট করে র'চা বানালাম অথচ বলে কিনা দুধ চা পছন্দ করে।
- শুনেছি সে আজ অনেক বড় মানুষ কিন্তু সে দিন আমার র'চা না খেলে কি এত বড় মানুষ হতে পারত?
- ক'ই কেমন বড় মানুষ সে, একদিনও আমার কোন খবর নেয় না।
নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত একজন রোগী বন্ধু সেজে অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় যাতে করে পরবর্তী সময় সেটা ফলাও করে নিজের প্রচারে এবং সেই সাহায্যগ্রহনকারীকে ছোট করতে ব্যবহার করা যায়।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্টের উপকারের জন্য আপনি সাধ্যমত যা'ই করেন না কেন সে আপনার যে কোন কাজকে ভাল না বলে খারাপ বলে প্রচার করবে।
২) নার্সিসিস্টরা প্রথমেই দেখে নেবে আপনার দুর্বলতা বা প্রিয়-অপ্রিয় জিনিস কি কি। তারপর সেই সূত্র ধরে বন্ধু-সাহায্যকারী-চাটুকার-সমব্যথী ইত্যাদির বেশে আপনার পাশে আসবে আপনাকে প্রভাবিত/MANUPULATION করে আপনার ক্ষতি করতে।
ধরুন, আপনি খুব লাল গোলাপ ফুল পছন্দ করেন এবং সেই কারনে আপনার বাগানের লাল গোলাপের সুনাম আপনার এলাকার সবখানে। নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত রোগী যখন আপনাকে টার্গেট করবে শিকার হিসেবে, তখন সে একদিন আপনার লাল গোলাপের বাগান দেখতে গিয়ে এত সুন্দর-সুন্দর ভাল কথা এবং প্রশংসা করবে যে আপনি বিমোহিত হয়ে যাবেন তার কথায় (বা পাম'এ)। আপনি ধরেই নেবেন আপনি এতদিন পরে একজন সমঝদার লোকের দেখা পেয়েছেন এবং সত্যিই সে আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনি হয়তো খুশিতে তাকে আপ্যায়নও করে বসবেন। কিন্তু ঐ রোগী আপনার বাগান দেখে ফেরার পথে বিদায় বেলায় (শুরুতেই নয় কিন্তু) আপনাকে আরো অনেক ভাল-ভাল কথা বলার সঙ্গে আরো বলবে যে, লাল গোলাপের সাথে হলুদ গাঁদা ফুল'ও ভালো লাগে দেখতে।
আপাত দৃষ্টিতে এই কথাটির কোন দাম না থাকলেও কিছুদিন এই নার্সিসিস্টের আপনার বাগানে আসা-যাওয়ার পর দেখবেন আপনি তার কথায় প্রভাবিত হয়ে ঐ লাল গোলাপের বাগানে (যার জন্য আপনার এত সুখ্যাতি এলাকা জুড়ে) হলুদ রঙের গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো শুরু করেছেন। এবং আপনার সেই (অসুস্থ) শুভাকাঙ্খী বাগান পরিদর্শক এলাকায় প্রচার শুরু করে দিয়েছে যেঃ
- কই তার বাগানে নাকি শুধুই লাল গোলাপের গাছ?
- এটি সম্পূর্ন মিথ্যা কথা।
- হলুদ গাঁদা ফুলের গাছও প্রচুর আছে।
- আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি।
- বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখে আস।
নার্সিসিস্টদের কথা এবং কাজের ধরনই এমন। আপনি সময় মতো তার কাজের প্যাটার্ন ধরতে না পারলেই বিপদ। তাদের কথা এবং কাজে বিভ্রান্ত হয়ে আপনার আমও যাবে ছালাও যাবে। যেমন আপনার লাল গোলাপের বাগানও গেল, ঐ এলাকায় আপনার সম্মানটাও গেল।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনার যে কোন কাজে সামান্য হলেও খুঁত বের করে নিজের স্বার্থে সুবিধা অনুযায়ী সবাইকে রটিয়ে বেড়াবে।
৩) একজন নার্সিসিস্ট'এর সাথে আপনি যতই পজিটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাল ব্যবহার বা ভাল সম্পর্ক (HEALTHY RELATION) করার চেষ্টা করেন না কেন, সে কখনই আপনার কাজ এবং অনুভূতির কোন দাম দেবে না। সে সবসময় চেষ্টা করবে আপনার সম্পর্কে যে কোন কথা খারাপ ভাবে তিল কে তাল করে রটিয়ে বা সরাসরি আপনাকে দোষ দিয়ে আপনার মনকে ছোট করে বা আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে তাকে আপনার উপরে বড়/(SUPERIOR) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে সে আপনাকে নিয়ন্ত্রন/CONTROL করতে পারে।
আপনি যদি নার্সিসিস্টের কাজে বা কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখান তখন সে যে কোন তুচ্ছ বিষয়ের অজুহাতে আপনার সাথে তাচ্ছিল্য - ব্যাঙ্গ - উস্কানি মূলক কথা শুরু করবে যাতে তার সাথে আপনি ঝগড়া শুরু করেন। ব্যাস, তাকে আর পায় কে? সে সবাইকে বলে বেড়াবে যে আপনি খারাপ/তার সাথে ঝগড়া করেন। অথচ তার উস্কানিতেই ঝগড়া শুরু হয়েছে ব্যাপারটি সে বেমালুম চেপে যাবে। অথবা অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ তুলে সে এত দ্রুত কথা/ঝগড়া করা শুরু করবে যে আপনি মূল প্রসঙ্গ টেনে আসল পরিস্থিতি বলার বা আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোন সুযোগই পাবেন না।
একজন নার্সিসিস্ট হলো সেই ব্যক্তি, যে সচরাচর নিজের নাক কেটে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করে।
আপনি একজন নার্সিসিস্ট'কে গরমের দিনে নিজের এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে ডেকে এনে আপনার সবচেয়ে সুন্দর ডিজাইন করা দামী গ্লাসে বাগানে নিজের হাতে লাগানো এবং বড় করা গাছের কাগজি লেবু কেটে মিষ্টি ঠান্ডা শরবত বানিয়ে খেতে দিয়ে পাশের ঘরে গেলেন আরো আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। ঐ নার্সিসিস্ট আপনার বানানো শরবত এক নিমিষে সাবাড় করে ঐ গ্লাসের ভিতর ঘরের কোনা থেকে কোন ময়লা বা টিকটিকির বিষ্ঠা দিয়ে রাখবে এবং আপনি এলেই দেখিয়ে বলবে যে, সে শরবত খেয়েছে কিন্তু গ্লাসের তলায় এই ময়লা ছিল। সে চাইবে, যাতে আপনি তাকে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর জন্য হীনমন্যতা এবং আত্মগ্লানিতে ডুবে যান এবং তাকে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর বিষয়টি ভুলিয়ে আপনি অন্য বিষয়ে আরো খুশি করার চেষ্টা করেন। এবং এই নার্সিসিস্ট, কারনে -অকারনে ময়লাযুক্ত শরবত খাওয়ানোর প্রসঙ্গটি তুলে/খোঁটা দিয়ে আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে চেষ্টা করবে আপনাকে নিয়ন্ত্রন করে নিজের ফায়দা লোটার।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট সবসময় আপনার অতীতের এমন কিছু বিষয় সবাইকে বলে বেড়াবে যাতে আপনি ছোট হয়ে আত্মগ্লানীতে ভোগেন।
৪) আত্ম অহমিকা, অহং বোধ বা অহংকারের কিছু বিষয় আমাদের সবার মধ্যে কিছুটা থাকলেও নার্সিসিস্টদের মধ্যে আত্ম অহংকারের দাম্ভিকতা/ARROGANCE খুব প্রকটভাবে দেখা যায়। তারা নিজেদের সামনে অন্য কাউকে মানুষ হিসেবে দাম দেয় না। নিজেকে ছাড়া অন্য সবার ভিতরেই ভুল-ভ্রান্তি-দোষ-ত্রূটি দেখিয়ে সবাইকে তা ফলাও করে প্রচার করে থাকে যাতে নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো যায়।
যেকোন কাজে একজন নার্সিসিস্টের কোন অবদান/গুরুত্ব থাক বা না থাক বা যতটুকুই থাক, সে ছলে-বলে-কৌশলে সবসময় চেষ্টা করে সেই কাজে সম্পৃক্ত অন্য সবাইকে হেয়/ছোট/DOMINATE করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ন/বড় হিসেবে প্রতিষ্টা করতে।
যেমনঃ দোকানে বাঁকী কিনে টাকা পরিশোধ না করা এবং টাকা পরিশোধের নামে ঘোরানো, নিকটাত্মীয়দের অর্থ-সম্পদ লোপাট, মিথ্যা কথা বলে আমানতের খেয়ানত, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি।
যাতে করে নার্সিসিস্টের পেছনে তার শিকার/VICTIM নিয়মিত তাগাদা বা নিজের জিনিসের মূল্য পরিশোধের জন্য বা নিজের আমানত ফিরিয়ে নিতে বা কাজের জন্য বারবার ঘোরে। তার কাজে অন্য মানুষ যতই কষ্ট পাক না কেন, একজন নার্সিসিস্ট নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ন মনে করতে বা আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে লোক দেখাতে, পারেনা এমন কোন কাজ নেই।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট সবসময় নিজেকে সবজান্তা মনে করে এবং বিশ্বাস করে তার নিজের কোন কাজেই সামান্যতম কোন ভুল নাই।
৫) একজন নার্সিসিস্টের কোন সত্যিকারের বন্ধু-বান্ধব নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন ব্যক্তি তাকে আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তার পিছে ঘোরে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির সাথে নার্সিসিস্টের সম্পর্ক থাকে। অথবা অন্য কথায় বলা যায়, একজন নার্সিসিস্ট ততক্ষণ পর্যন্তই অন্য কারো সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রন/প্রভাবিত/হেয়/ছোট (CONTROL/MANUPULATE/DOMINATE) করে নিজের অহমিকাকে ফুলিয়ে বড় (EGO BOOST)
করতে পারে ।
একজন নার্সিসিস্ট, সমাজে নিজের সমমান বা তার থেকে উচ্চমানের মানুষদের বাদ দিয়ে নীচুমানের মানুষদের সাথে মেলামেশা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কারন নিজের থেকে নিচুমানের মানুষদের সহজেই প্রভাবিত করে নিজেকে বড়/SUPERIOR হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, দাম পাওয়া যায় এবং আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। ক্ষেত্র বিশেষে সুবিধা অনুযায়ী একজন নার্সিসিজম রোগীকে 'শক্তের ভক্ত-নরমের যম' হিসেবেও অন্যের সামনে আবির্ভুত হতে দেখা যায়।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট খুবই কুটিল-জটিল মনের অধিকারী (MEAN - COMPLEX MINDED), সে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হতে চায় (COLTROL FREAK) এবং তার কাছে আপনার চাওয়া-পাওয়া-আবেগ-অনুভূতির কোন দাম নাই।
৬) অন্যকে ব্যবহার করে অন্যের কাছ থেকে কাজ করে নেওয়াতে একজন নার্সিসিস্টের কোন জুড়ি নেই। খেয়াল করলেই দেখবেন যে, সুন্দর-সুন্দর কথা বলে বা কাকুতি-মিনিতি-হাহাকার-আফসোস (নিজেকে VICTIM হিসেবে উপস্থাপন)'এর মাধ্যমে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিখুত মুখভঙ্গী/কান্না/হাসি/অভিনয়'এর মাধ্যমে অন্যকে প্রভাবিত করে একজন নার্সিসিস্ট সহজেই শুধু মাত্র নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অন্যকে দিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে নেয়।
নিজে না করে অন্যকে দিয়ে কাজ করালে সুবিধা হলোঃ সেই কাজের যেকোন ভুল-ত্রূটি বের করে যে ব্যাক্তি (বা ব্যাক্তিরা) ঐ নার্সিসিস্টকে কাজটি করে দিয়েছিল, তাকে সহজেই দোষ দিয়ে দোষী বানানো যায় এবং তাকে বারবার ঐ কাজের ভূল-ত্রূটির বিষয় উল্লেখ করে/খোঁটা দিয়ে, তার মধ্যে অপরাধবোধ জাগিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনাকে হীনমন্যতায় ডুবিয়ে আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগিয়ে আপনাকে এমন হেয় করবে যে আপনি নিজের পরিচয়ে নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাবেন।
৭) নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত একজন রোগী সবসময় চায়, সবাই তাকে আসরের মধ্যমণি হিসেবে দেখুক। সবাই তার দিকে দৃষ্টি দিক। যখনই সে দেখে অন্য কেউ তার থেকে বেশি মনোযোগ (ATTENTION) পাচ্ছে, তখনই সে নিজের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে অস্বাভাবিক কাজ শুরু করে।
যেমনঃ আপনি (না জেনে/চিনে) একজন নার্সিসিস্টকে বন্ধুদের সভায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই সভার মূল বিষয়ের আলোচনার প্রাক্কালে ঐ নার্সিসিস্ট চেষ্টা করবে যে কোন উপায়ে (অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গে অনর্গল কথা বলে বা সেই ঘরে থাকা কোন ছবি/ক্যালেন্ডার/স্যুভেনির ইত্যাদি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলে বা টেবিল/চেয়ার ঠুকে শব্দ করে বা নিজে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছে, ইত্যাদি) নিজের দিকে সবার দৃষ্টি ফেরাতে।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনাকে ফাঁদে ফেলে ব্যক্তিগত/সামাজিক ভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যে আপনি মনে-মনে বা সবার সামনে চরম অপমানিত, মানসিক ভাবে আহত এবং প্রতারিত হলেও সরাসরি কাউকে ঐ নার্সিসিস্টের কোন দোষই দেখাতে পারবেন না, মনে হবে সব দোষই আপনার নিজের।
৮ ) আপনি মানেন বা না মানেন, একজন নার্সিসিস্ট মনে-প্রানে বিশ্বাস করে সে সবার থেকে বড় (SUPERIOR COMPLEX)। প্রথমদিকে সে আপনার সাথে বর্ণচোরা বন্ধুবেশে মেলামেশা শুরু করলেও তার কথা এবং কাজে আপনি প্রমান পেতে শুরু করবেন যে একজন অসুস্থ নার্সিসিস্ট।
সে নিজেকে সবকিছুতেই সর্বজ্ঞানী (EXPART) হিসেবে উপস্থাপন করে চেষ্টা করবে আপনাকে নিজের মতো করে পরিচালনা করে কাজ করাতে। আপনি যদি তাকে সম্পুর্ন অজানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে না জানলেও বলবে সে জানে তবে আজ নয় পরে বলবে। যাতে করে তার দিকে আপনি মনোযোগ (ATTENTION) দিয়ে রাখেন।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্টকে সনাক্ত করতে পেরে আপনি আপনার কোন কাজে তাকে বাধা দিলেও সে কিছুটা বিরতি নিয়ে সময় বুঝে অন্য ভূমিকা/চরিত্র'এর বেশ ধরে আপনার কাছে সেই পুরনো রাগ নিয়ে ক্ষতি করতে বারবার ফিরে আসার চেষ্টা করবে। সে আপনাকে অর্থ-সম্পত্তির প্রলোভন দিতেও পিছপা হবে না। তাকে সুযোগ দেবেন তো তার ফাঁদে ধরা পরবেন।
৯) অন্যকে প্রভাবিত (MANUPULATE) করতে একজন নার্সিসিস্টের খুবই কমন ডায়লগ হলো, 'আর ক'দিনই বা বাঁচব?' বা 'আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা' বা 'আর কোন দিন তোমাকে বলব না' বা 'নিজের কাল্পনিক শারিরীক অসুস্থতার অজুহাত' বা 'তোমার বয়সে আমি এটা/সেটা করেছি' বা 'তোমার জায়গায় আমি হলে এটা/সেটা করতাম' বা 'আমার নিকটাত্মীয় মারা গেছে বলে কোন সুবিধা আদায়' বা 'আগামী অমুক বিশেষ দিনের পরে এই কাজ শুরু করবো (মিথ্যা অজুহাত)' ইত্যাদি।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট খুবই আত্মকেন্দ্রিক। তার সবকিছুই সে নিজে কি ভাবে, কি চায়, কি অনুভব করে ইত্যাদি ঘিরে। তার সঙ্গে যে'ই থাক না কেন তার/তাদের মতামত-ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছুই তুচ্ছ।
১০) নার্সিসিস্টরা সবসময় মিথ্যাবাদী। তাদের পুরো দুনিয়াটাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের কাজে এবং কথায় সহজেই এটি ধরা যায়। খুবই নীচ স্বভাবের কারনে চুরি করে/ইচ্ছা করে/আড়ি পেতে কারো (বিশেষ করে পরিবারের কাছের মানুষদের) গোপন বিষয় (পোষাক বদল,গোসল, একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়/সময়) দেখা/ছবি তোলা, অন্যের ব্যক্তিগত চিঠি-ডায়েরী আত্মসাৎ করা এবং সেগুলি পড়া এবং পরবর্তী সময়ে তার শিকার/(VICTIM)-কে জানানো যে সে তার গোপন বিষয়গুলি জানে, ইত্যাদি একজন নার্সিসিস্টের জন্য খুবই সাধারন ব্যাপার।
এ ভাবে একজন নার্সিসিস্ট তার শিকার/(VICTIM)-কে সবার সামনে বা গোপনে লজ্জাজনক/ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতিতে ফেলে ব্ল্যাকমেল করে গোপনে/সবার সামনে ছোট করে/(DOMINATE) তাকে নিয়ন্ত্রণ/ (CONTROL) করার চেষ্টা করে।
মনে রাখবেনঃ একজন নার্সিসিস্ট আপনার কষ্ট দেখে-শুনে আনন্দ পায় এবং এই কারনেই সে আপনার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে যাতে আপনি যেভাবেই হোক যেন কষ্ট পান। এটিই তার বিনোদন। বন্ধু-শুভাকাংখী-পরোপকারীর ভুমিকায় এসে সবসময় সে আপনার সুবিধার চেয়ে অসুবিধা-সমস্যার কথা বেশি শুনবে এবং কোন বাস্তব সমাধান না দিয়ে সবজান্তার ভান করে সেগুলি নিয়ে ডিটেইল আলোচনা করবে যাতে করে মনে মনে সে নিজেকে আপনার চেয়ে সুখি তুলনা করে আত্মতৃপ্তি পায়। তার সাথে আপনার সুবিধার কথা আলোচনা করলে সে চেষ্টা করবে সেগুলি যে ভাবেই হোক নষ্ট করার এবং আপনার কাছ থেকে সরিয়ে নিজে পাবার।
নিশ্চয় আপনি বুঝে গেছেন কিভাবে একজন নার্সিসিস্টকে চিহ্নিত করা যায়।
আসুন এখন দেখি কেন একজন মানুষ নার্সিসিস্টে পরিনত হয় এবং কিভাবে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই শৈশব, বয়ঃসন্ধি এবং কৈশোর তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে খুব বড় ভূমিকা রাখে। যে ব্যক্তি শৈশব থেকে পরিবারে খুব আদরে এবং অন্যের কাছ থেকে খুব বেশি মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত, তারা বড় হয়েও সেই আদর এবং মনযোগের কাঙ্গাল হয়। আবার যারা একেবারে অনাদরে এবং অমনোযোগে বেড়ে ওঠে, তারাও বড় হয়ে অন্যের কাছ থেকে আদর এবং মনোযোগ পাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বড় হবার পর সমাজে যখন সে নিজের যোগ্যতার চেয়ে বেশি দাম পায় না, তখন সে নিজের হীনমন্যতা ঢাকতে - নিজের কাল্পনিক দাম পেতে পরিবার, কাছের মানুষ এবং সদ্য বা স্বল্প পরিচিতদের সাথে মনের খেলা (MIND GAME) শুরু করে প্রভাবিত করে নিজের কাল্পনিক দাম বাড়ানো/আকর্ষনের কেন্দ্র হতে চেষ্টা করে। মূলত, এ কারনেই একজন নার্সিসিস্টের জন্ম হয়।
সেই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্বভাব, রুচি, অভ্যাস, পরিবার, সামাজিক পরিবেশ দিনে-দিনে তাকে মানুষের শরীরের আড়ালে মানসিক ভাবে অমানুষে পরিনত করে। একজন নার্সিসিস্ট কিছুতেই বুঝতে পারে না অন্য মানুষদেরকে (বেশিভাগ ক্ষেত্রে নিজ পরিবারের সদস্যদের উপর এবং কর্মক্ষেত্রে অধঃস্থনদের উপর) মানসিক অত্যাচার - অকারনে হয়রানি, কাজের ছেলে/মেয়েদের - সন্তানদের - আশ্রিতদের বেধড়ক মারপিট, পোষা প্রানীদের উপর অকারনে অত্যাচার বা মেরে ফেলা ঠিক না। তার মধ্যে অন্য যেকোন জীবের প্রতি কোন দয়া (PITTY), সহানুভূতি (SYMPATHY) এবং সহমর্মিতা (EMPATHY) কাজ করে না।
জন্মগতভাবে যখন এই মানবিক বোধগুলি/ মানবীয় গুণাবলী একজন নার্সিসিজম রোগীর মধ্যে থাকেনা তখন সে একজন সাইকোপ্যাথ (PSYCHOPATH)'এ পরিণত হয়। আর যখন সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে এই মানবিক বোধগুলি/ মানবীয় গুনাবলী একজন নার্সিসিজম রোগীর ভিতর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তখন সে সোশিওপ্যাথ (SOCIOPATH) 'এ পরিণত হয়।
যেহেতু মানসিক রোগ নার্সিসিজমের কোন ঔষুধ এবং প্রতিকার নাই এবং অন্যের অবেগ, অনুভূতি এবং মন নিয়ে খেলা করাই অসুস্থ নার্সিসিজম রোগীর প্রধান কাজ সেহেতু তাকে চিহ্নিত করতে পারলেও তাকে সারাতে/ চিকিৎসা/ বলতে যাবেন না যে সে মানসিক রোগী। হিতে বিপরীত হবে। যদি পরিবারের মধ্যেই নার্সিসিস্ট থাকে তবে চেষ্টা করুন তার সাথে যত কম লেন-দেন, মেলা-মেশা, কথা বলা বা যে কোন বিষয়ে শেয়ার করা যায়।
মনের ভিতরে একজন ভিরু-হীনমন্য-নীচ এবং অত্যাচারী নার্সিসিস্টের বাইরের চরিত্রের সবকিছুই তার মুখোশ। আর সেই মুখোশ দেখতে তার আয়নার প্রয়োজন। আপনার উপর তার মানসিক খেলা/ (MIND GAME)’এর প্রতিফলন এবং প্রভাবই হলো সেই আয়না, যার মাধ্যমে সে নিজেকে আপনার নিয়ন্ত্রক হিসেবে অনেক বড় করে দেখে।
চেষ্টা করুন একজন নার্সিসিস্টকে সম্পূর্নভাবে এড়িয়ে চলতে। ব্যাক্তিগতভাবে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এড়িয়ে চলুন। সহানুভূতি নিয়ে সাহায্য করার জন্য একজন নার্সিসিস্টের পাশে দাঁড়াবেন তো তার ফাঁদে ধরা পরবেন।
0 টি মন্তব্য:
Post a Comment